Monday, May 29, 2017

ফ্রী লিটিল লাইব্রেরী


আহা সত্যযুগ থাকলে কি ভালো না হতো । এখন তো শুধু  কি করে অপরের মারা যায় আর কি করে লোকেদের পেছনে বাঁশ দেওয়া যায় সেই নিয়ে সব সময় জল্পনা কল্পনা । সেই নচিকেতার গান আছে না , “সবাই সবার পেছনে আর সবার হাতে কাঠি” । এই সব ভাবতে ভাবতে প্রত্যেক দিনের মত হাঁটছিলাম । এই সুন্দর নধর ভুঁড়িটা এবার নামাতেই হবে । সামনেই ভাইয়ের বিয়ে, প্রচুর ছবি টবি উঠবে । নিজেকে ভালো দেখাতেই হবে । সময় ধরে রাখার এই একমাত্র জিনিস হচ্ছে ছবি । একটা কথা জানো তো, আমরা কারো মুখ মনে রাখতে পারিনা । আমরা ঘটনা মনে করি , আর মুখ বানাই । তাই আমরা তাদেরই মনে রাখি যাদের সাথে আমাদের কিছু না কিছু স্মৃতি আছে।  আর এই ছবি আমাদের স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে। পুরনো ছবি ঘাঁটতে থাকো , দেখবে অনেক ভুলে যাওয়া স্মৃতি সামনে এসে পরবে ।
            

যাইহোক , রোজকার মত ফিটবিট হাতে লাগিয়ে আমি হাঁটা শুরু করেছিলাম সেদিনও। যেহেতু একই রাস্তা ধরে হাঁটাটা বিরক্তিকর তাই আমি প্রত্যেক দিন নতুন নতুন রাস্তা ধরতাম । মাঝে মাঝে হারিয়েও জেতাম, আর তারপর জি পি এসে ডায়রেক্সন টু হোম করতাম । শরীরের নাম মহাশয়, যা সয়াবে তাই সয় । কিন্তু ভুঁড়ি কমানোর জন্য এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে শরীর যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে যে তাকে খাটানো হচ্ছে । একই রাস্তায় যদি রোজ হাঁটি তাহলে শরীর সেই রাস্তাটা কি করে কম এনার্জি খরচা করে অতিক্রম করতে পারে সেই ধান্দায় থাকবে । তাই এই প্রত্যকেদিনের নতুন নতুন রাস্তা অন্বেষণ।


            সেদিন একটা ট্রেল ধরে হাঁটছিলাম অনেক্ষন। চারপাশ জঙ্গলময় । মাঝে মাঝে ছোট ছোট সোঁতা পার করে জাচ্ছিলাম । বড় বড় কাঠবিড়ালি মাঝে মাঝেই আমার পায়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে জাচ্ছিল। আমার এই ছোট্ট শহর অবারন হিলস বেশ মিষ্টি । মিশিগানের জাঁকানো শীত বাদ দিলে সারাটা বছর বেশ ছিমছাম এই শহর। বেশ কিছু ট্রেল আছে, আমাদের মত ভুঁড়ি কমানোর উদ্যেশ্যে বারমুডা পরে ছুটে বেরানো লোকদের জন্য । এই ট্রেলটার নাম ক্লিনটন রিভার ট্রেল । প্রায় তের মাইল লম্বা এই ট্রেল অনেক কটা শহরের মধ্যে দিয়ে গেছে । তাই এক নাগাড়ে জঙ্গল নয় । মাঝে মাঝে রাস্তাও পেরোতে হয় । আর যখন ইচ্ছা , যেকোনো একটা গলি দিয়ে বেরিয়ে গেলেই নতুন শহর।


            যদিও দেখতে প্রায় একই রকম, কিন্তু প্রত্যেক শহর শুধু না , প্রত্যেক পাড়ারও এক একটা বৈশিষ্ট আছে । নতুন নতুন যখন এসেছিলাম তখন ব্যাপারটা ধরতে পারতাম না । কিন্তু অন্ধকারেও চোখ সয়ে যায় । এখন বেশ মজা লাগে, যেকোনো পাড়ায় ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস আর বর্তমানের রঙ্গ দেখতে ।


            ট্রেল থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক নিতে ঢুকে পরলাম একটা পাড়ায় । বাড়িগুলো দেখতে সব একই রকম । মানে এক সাথে বানানো বা এক সাথে দানে পাওয়া। আমাদের সল্টলেকের মতই কেস । অনেক বাড়িতে দেখলাম ভেটারেনের ফ্লাগ টাঙ্গানো আছে । বাড়িগুলোর ব্যাক ইয়ার্ড নেই । তার মানে নিতান্তই গরিব পাড়া । যদি এটা নিউ ইয়র্ক বা শিকাগো হতো তাহলে এগুলই মিলিয়ানিয়ার দের বাড়ি হতো । কিন্তু এটা একেবারেই ব্যাংকরাপট ষ্টেট ।তাতেও ব্যাক ইয়ার্ড নেই যখন তখন কিছুই নেই । গরীব কমিউনিটি ।

            এদিক ওদিক দেখতে দেখতে জাচ্ছি হঠাৎ নজরে পরল এই খেলনা বাড়িটার দিকে । দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগছিল । মনে হয়েছিল কোনও বাচ্ছার জন্য বানানো হাইডিং প্লেস । কিন্তু কাছে আসতে আসতে, গায়ে চিপকানো লেখাটা পরলাম। “Free Little Library” । সামনে গিয়ে দেখলাম , ভেতরে বেশ কিছু বই আছে । ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকল । তারপর বইগুলো দেখলাম যথেষ্ট নতুন । কালেকশানও খারাপ নয় । বেশিরভাগই ক্লাসিক , কিন্তু হ্যারি পটার আর ডান ব্রাউন উঁকি মারছিল । আমি এদিক ওদিক তাকালাম। আমি কি নিতে পারি ? না মনে হয় । কমিউনিটির জন্যই হয়ত বানানো হয়েছে । যারা নেবে তারা হয়ত সবাই পরিচিত । আমি নিতে গেলেই হয়ত বাড়ির পেছন থেকে একটা ল্যাব্রাদর বেরিয়ে আসবে বা অন্তত ছবি তুলে নেবে আর পরে বাড়িতে সাবপিওনা আসবে ।



            কিন্তু আমার এই জিজ্ঞাসু মনটা কখনও বাঁধ মানে না । কিছু নতুন দেখলেই আমার এন্টেনা টং করে ওঠে। এরকম লাইব্রেরিতে তো যে কেউ বই ঝেড়ে দিতে পারে । যারা নিয়ে যাবে তারা নাও ফেরত দিতে পারে। ফ্রি ইস ফ্রি । আমরা তোঁ যা ফ্রি তা পরিমানের বেশি নিয়ে বাকিটা ফেলেও দি । তবে কি কেউ স্প্রিং ক্লিনিং এর নতুন ধান্দা বার করেছে , নাকি বই ফেলে দিতে গায়ে লাগে, তাই এটা এক প্রকার ডোনেট করার জায়গা । যাইহোক , ব্যাবস্থাটা কিন্তু বেশ ।


            অনেকবার ইতস্তত করে একটা বই হাতে তুলে নিলাম । আমি আশা করেছিলাম , বইগুলোর পাতা ছেঁড়া থাকবে, বা কেউ ডুডল করে থাকবে । লাইব্রেরিয়ান যখন বই ফেরত নেয়, তখন বই দেখে ফেরত নেয় শুধু মানুষের এই ধ্বংসাত্বক ব্যাবহারের জন্য । সুন্দর কিছু দেখলেই প্রচুর মানুষের মধ্যে সাদ্দাম জেগে ওঠে । একটু খুঁচিয়ে না দেখলে কারোর শান্তি নেই । কিন্তু এখানে তো লাইব্রেরিয়ানই নেই । কিন্তু আমাকে অবাক করে হাকেলবারি ফিন এর পাতাগুলো নিখুঁত ভাবে ছিল । এমনকি পাতার কোনাও কেউ ভাঁজ করেনি । তবে বেশ বোঝা জাচ্ছিল বইটা অনেক বার পরা হয়েছে । মাঝের বাঁধন আলগা ।


            বাকি বইগুলো দেখতে চোখে পড়ল হারপার লি এর টু কিল এ মকিংবার্ড । বইটা পরিনি , নাম শুনেছি অনেক । তাই তুলে নিলাম বাড়ি নিয়ে যাব বলে ।  কেউ আটকালো না , কেউ কুকুর ছেড়ে দিল না , আমি বিন্দাস বই নিয়ে ফেরত চলে এলাম ।

            এর পর বেশ কিছুদিন চলে গেল । ফ্রি এর বইও পরা হয়নি । ফেরতও দিতে জাওয়া হয়নি । হাঁটা কিন্তু থামেনি । রাস্তা বদলে গেছে । বেশ মাস খানেক পর হঠাৎ বইটার দিকে নজর পড়তে লজ্জা লাগলো । কিন্তু মনে হল , না ফেরত দেব না। আগে দেখে আসি । ফালতু মোটা বইটা এতটা রাস্তা বয়ে নিয়ে গিয়ে যদি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় । পাগল ছাগলের দেশ হঠাৎ মনে হয়েছে কেউ বানিয়ে দিয়েছে । হয়ত গিয়ে দেখব কেউ তুলে নিয়ে চলে গেছে । কিন্তু আমায় অবাক করে ফ্রী লিটিল লাইব্রেরি বহাল তবিয়তে সেখানে বর্তমান । স্মৃতি কুড়িয়ে বারিয়ে দেখলাম বইগুলো পালটে গেছে । কিছু তখনও এক আছে । কিছু পালটে গেছে ।


            ব্যাপারটা আমায় অবাক করে দিল । এরপর দু তিন দিন অন্তর অন্তর আমি ঢুঁ মারতে লাগলাম লাইব্রেরি তে । আর প্রত্যকবারেই দেখলাম বই পালটে জাচ্ছে । পুরানো বই ফিরে আসছে । নতুন বই অ্যাড হচ্ছে। বইগুলো জায়গা পরিবর্তন করছে । তার মানে আমি একা সেই লাইব্রেরির ভিসিটর নই । কিন্তু এতটাই ছিমছাম জায়গা যে আর কখনও কাউকে দেখলাম না বই দিতে বা নিতে ।


আমি আমার বই জথাস্থানে রেখে দিয়ে এলাম । আর ভাবতে লাগলাম , সত্যযুগ কি আছে । আমাদেরি প্যারালাল পৃথিবীতে । যে শহরে চুরির হার বেশি বলে ইনসিওরেন্স এর প্রিমিআম বেশি । সেই শহরেই এই ঘটনা আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছিল । না কি বই এখন চূড়ান্ত অবহেলিত জার কারনে কেউ হাত পর্যন্ত লাগাতে চায় না । কিন্তু সেটাও তো ঠিক কথা নয় । তাহলে বইগুলো পালটে যেত না । মানুষ যে কি বিচিত্র তা এই অভিজ্ঞতা থেকে ভালই টের পেলাম ।   

No comments:

Post a Comment