Tuesday, May 30, 2017

সুইসাইডের ঠিক আগে




আর মাত্র কয়েক মিনিট।  তার পরেই আমি আর আমি নই।  আমার দেহ , যা আমার সবথেকে প্রিয়, সবথেকে আপন ; তার কোনো প্রয়োজন থাকবে না। আমায় যারা নার্সিসিস্ট বলে তারা হয়তো এবার থামবে। বাথরুম আটকে আজ আর আমি নিজের শরীরের দিকে তাকাবো না।  ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকবো না পৃথিবীর সবথেকে প্রিয় জিনিসটির দিকে - আমার দিকে।  আয়নার সামনে আজ আমি নিজের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করবো না।  কি কঠিন ছিল প্রশ্নগুলো।  আমি যদি ওরকম না করতাম তাহলে কি হতো? আমি যদি এরকম করি তাহলে কি হবে? আমার যদি সেইরকম না হয় ভবিষ্যতে তাহলে আমার কি হবে? প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কেউ তখনও ছিল না, আজও নেই।  তাহলে যে ঘন্টার পর ঘন্টা একা আমার এই ওয়ান রুম কিচেনের বাথরুমে বসে শাওয়ার চালিয়ে প্রশ্ন করে করে নিজের কাছে নিজেই ছোটো, বড় , মাঝারী হয়েছিলাম , সব কি জাস্ট ওয়েস্টেজ অফ টাইম ? কি বিরক্ত হতো সবাই, যখন অফিস থেকে ফিরে রোজ কারো না কারুকে ফোন করে আমার একাকীত্বের সঙ্গী বানাতাম।  আমার তো ফ্রি ফোন।  অফিস পেড।  ওদেরও তো পয়সা খরচ হতো না।  শুধু খরচ হতো সময়।  সময় কি সত্যি এতটাই দামি।  আমার জন্যে কারো কি এইটুকু সময় নেই। কোথায় কিনতে পাওয়া যায় এই সময়।  আমার কাছে প্রচুর টাকা।  টাকা দিয়ে তো সব কেনা যায়।  আমি কিনে এনে দেব তাদের জন্য।  আমি তাদের জন্যও কিনবো।  আমার জন্যেও।  তাদেরটাও খরচ করবো , আমারটাও।  তবু কেন তারা বলে ওঠে  - ব্যস্ত আছি, পরে ফোন করিস।  আমার কিন্তু ভালোই লাগতো একা থাকতে। কলেজে যখন সবাই লাফিয়ে কুপিয়ে বেড়াতো , তখন আমি সেই সর্ষে ক্ষেতে গিয়ে বসে থাকতাম।  গ্রামের কলেজ, মুড়ি আর ছোলার ছেঁচকি সঙ্গে নিয়ে যেতাম।  কি ভালো লাগতো একা থাকতে। ঘন্টার পর ঘন্টা নানা লেখকের সাথে গলায় গলা মিলিয়ে শব্দের সঙ্গে খেলা করতাম।  ডাইরির পাতা ভরে যেত।  কখনো ছন্দে , কখনো গদ্যে কখনো সনেটের অমিত্রাক্ষর ছন্দে গদ্যের বাষ্প মিশিয়ে এক বলয় তৈরী করতাম। বলে না সৃষ্টিই ব্লিস অফ সলিচিউড , একাকীত্বই সৃজনশীলতা আনে ।   তখন তো এই ট্যাব বা স্মার্টফোন ছিল না। হাতে ছিল অনেক সময়।  অনেক - অনেক সময়।  আজ প্রায় শেষ হতে চলেছে যার প্রয়োজন।  স্টপওয়াচের স্টপকক গলায় আটকে থাকতো সারাটা জীবন।  ইঁদুর দৌড়ে ইচ্ছা কখনোই ছিল না।  কিন্তু নিজের ইচ্ছায় কি আর মানুষ চলে। চলে না।  অন্য কারো ইচ্ছায় চলার ইচ্ছাই প্রেম।  সেই প্রেম তো করেছিলাম।  বন্ধু হতে , ভালোবাসতে।  প্লেটোনিকের ন্যাকামো থেকে , শেষের কবিতা সবই তো চেষ্টা করেছিলাম।  মিষ্টি মিষ্টি , ঝাঁঝালো , কড়া , তেতো বা আমলকির মতো প্রথমে কষ্টা পরে মিষ্টি।  সবই স্বাদ নিয়ে ও দিয়েছিলাম।  সারাজীবনের সঙ্গ দেব বলে চূড়ান্ত পরিশ্রমে যোগ্যতা প্রদর্শনের লড়াইয়ে জিতিনি তা তো নয়।  এই জেতা  হারার দৌড় কি তবে সেই ইঁদুর দৌড়।  কিন্ত জীবন যে হার জিৎ ছাড়া আর কিছু নয়।  শরীর সামনে এগিয়ে যায় , আর পা তাকে ব্যালান্স করতে থাকে , তাকে উলটে পড়তে দেয়না।  কখনো শরীর জেতে , কখনো পা।  এই ভাবেই তো মানুষ এগিয়ে যায়।  এই এগিয়ে যেতে যেতে আমি অনেককে পিছুতে ফেলে এসেছি।  ফিরেও তাকায়নি।  কেন তাকাবো?  তাদের কি আমি বারণ করেছিলাম আমার সাথে না দৌড়োতে।  তাদের জীবনের কাছে অনেক চাওয়া ছিল।  তাদের শান্তি লাগবে, আনন্দ লাগবে , রিলাক্সেশন লাগবে।  তারা দৌড়াতে দৌড়াতে দেখতে চায় না।  থেমে, এক জায়গায় বসে, চিবিয়ে চিবিয়ে শুধু খেতে চায় তা নয় , পরে উগলে আবার জাবরও কাটতে চায়।  আমার সবকিছুই দৌড়াতে দৌড়াতে।  আমি হাঙ্গর , থামলেই মৃত্যু।  তলিয়ে যাবো।  কিন্তু ভিড়ের থেকে একা হয়ে পড়েছি যখন বড় হয়েছি।  এটাই তো ছোটবেলা থেকে শিখেছিলাম।  যে যত বড়, সে ততো একা।  তার একাকীত্বই শান্তনা।  ঝাঁকের কৈ না হয়ে যখন অন্য স্রোতে গা ভাসিয়েছিলাম তখন সত্যি আমি ধরা পড়িনি অনেক জায়গায়।  কিন্তু একদিন বড়শির আগার  টোপ বুঝতে পারিনি।  কেউ বলে দেওয়ার ছিল না।  গিলে ফেলেছিলাম। হিড় হিড় করে টেনে তুলে আমার বড়শি বার করে ছেড়ে দিয়েছিলো জীবনের মাঝে।  ঠোঁটের ওপরটা  ছিঁড়ে গেছিলো কিন্তু বেঁচে গেছিলাম।  সেদিনের সেই একটু বাতাসের জন্য , একটু জীবনের জন্য যে খাবি খাচ্ছিলাম, আর কিছু মিনিটের মধ্যে সেই জীবন থেকে আমি বেরিয়ে যাবো।  আমি এখনো জানিনা কেন যাবো।  অনেক কারণ।  অনেক - অনেক - অনেক।  অপমান , অভিমান ,অবজ্ঞা , অনুতাপ , অসম্মান , অবহেলা  , অপপ্রচার আরো কত কি যে কারণ সে আমি আজ আর গুনতে চাইনা।  প্রতিনিয়ত তিল তিল করে বানানো এই শরীর আজ আমার কাছে এক বিরক্তিকর প্রাপ্তি।  ওই গীতাতে কি একটা যেন বলে না আমরা সবাই আত্মা।  সারাজীবন সেই আত্মার শুদ্ধি করি।  অধ্যাত্মিকতাই শেষ লক্ষ্য।  তাহলে আত্মহনের বিরুদ্ধে কেন সবাই।  তপস্যায় মৃত্যুবরণ বা মহাপরিনির্বাণ কি তাহলে নোংরামো।  আর আত্মহত্যায় ফেল করলে সেটা ক্রাইম  কেন? আমার জীবন রাখবো কি না রাখবো আমার ব্যাপার।  আমি থাকলাম কি না থাকলাম তখন তো কারো এসে যায় না । অঞ্জলির সময় তো কেউ ডাকতে আসেনি । যখন এক কড়াই গরম তেলে মাছটা ছাড়তেই অর্ধেক তেল এসে গায়ে পরে গেলো তখনও তো কেউ আসেনি ।  কি বীভৎস ফোস্কা পড়েছিল তখন।  একটু মলম গানোর জন্যেও তো কেউ আসেনি।  আজ তবে যখন আমি ব্লেড দিয়ে হাতটা কেটে ফেলবো , নিজের ইচ্ছায় , বন্ধ ঘরে , বন্ধ বাথরুমে , রাত দুটোয়, তখন কেউ কি আসবে আমায় বাঁচাতে।  আসবে না।  সকলেই চায় সমস্যাগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে ধরতে।  যেন আমি কিছুই বুঝতে পারিনা।  তারাই সব জানে।  সবাই বলে তোমার সমস্যা তুমি সমাধান করো।  আমার সমস্যা তো আমিই সমাধান করবো।  আমার সমস্যা যে কি সেটা তো আমিই ভালো জানি।  কিন্তু সবাই আগে বোঝাতে চায় যে ওদের দেখানো সমস্যাই আমার সমস্যা।  না , কখনোই নয়।  সারাদিন খেটে খুটে ঘরে ফিরে নিজের জন্যে চা বানানোটা আমার কাছে সমস্যা নয়।  আমার কাছে সমস্যা , একা এই ঘরে ঢোকার।  দুটো চড়ুই , দুটো শালিক যখন এসে ক্যা ক্যা করে ডাকতে থাকে , তখন তারাই আমার জীবনের সাথী।  তাদের কর্কশ আওয়াজ মিটিংয়ের মধ্যে মিউট বাটন প্রেস করতে বাধ্য করলেও তারা  আমার সাথে আছে।  দুটো পায়রা রোজ চেষ্টা করে ঘরে ঢুকে বাসা বাঁধবার।  ওরে , আমার বাসা যে আমি ভাঙতে  চলেছি।  দুটো ডিম পেড়ে তা দিতে জাবি যখন তখন যদি অন্য লোক এসে বাসায় লাথি মেরে ভেঙে দেয় তখন কি করবি।  তার থেকে আমি তোদের বাসাই গড়তে দেব না।  যারা আমার বাসা গড়ার জন্য হাত এগিয়ে দিয়েছিলো , তারা এখন সব হাত গুটিয়ে নিয়ে বলে দিয়েছে , - তোমার সমস্যা  তুমি সমাধান করো।  তাই করছি।  লোকে বলে আত্মহত্যা মহাপাপ , . কাপুরুষের কাজ।  কিসের পৌরুষ।  একা ঘরে কার কাছে শক্তির প্রদর্শন করবো।  পুরুষ তার বীর্য দিয়ে হয় আঘাত করে  নয় গড়ে।  এই ওয়ান রুম কিচেনে আঘাত করার মতো শুধু আছে মৃত অবলা সামগ্রী। এরা সকলেই আগেই দেহ রেখেছে , কিন্তু দিব্যি বর্তমান আছে।  আমারও দেহ থাকবে।  থাকবে কি ? শুনেছি মানুষের লাশ জলে পরিণত হতে বেশ কয়েকদিন লাগে।  ততদিনে তো কেউ এসে খোঁজ ও নেবে না।  অফিসের লোকেরা তো আমার এড্রেসও জানেনা।  তাদের সবথেকে বেশি দায়।  কত প্রেসেন্টেশন কত ডকুমেন্টেশান পেন্ডিং হয়ে থাকবে।  তারা খোঁজ নেবেই যে করে হোক।  কিন্তু ততদিনে আমি জল - আমি হাওয়া - আমি বাষ্প।  আমার সত্যি কি কোনো প্রয়োজন আছে এই পৃথিবীতে।  সবাই তো বলে নো বডি ইস  ইনডিসপেনসিবলে।  তাহলে একশো কোটির দেশে আমার দরকার কি ? আমি থাকলেও যা না থাকলেও তাই।  তাহলে ? আত্মীয় স্বজন পরিবার পরিজন।  ছ্যাঃ।  মা বাবা বাদ দিয়ে সব ধান্দাবাজ।  যতক্ষণ দরকার ততক্ষন আছে।  রস নিংড়ে ছিবড়ে ফেলে দেওয়া।  কারো কিছু এসে যায় না।  আমার জন্য শিয়াল কুকুরেও কাঁদবে না।  আর কাঁদলেই বা কি , আমি কি শুনতে পাবো।  না।  আমি তখন কি অবস্থায় থাকবো।  ঠিক যেমন গাঁজা খাবার মতো হয় , তেমন।  তলিয়ে যেতে থাকবো গভীরে - আরো গভীরে।  নরকে যাবো না স্বর্গে।  ননভেজ মানুষ - নরকে তো যাবোই।  বৈতরনী তো পার হতেই হবে।  ভয় কি ?যদি নরক না থাকে তবে আর কি - কেল্লা ফতেহ , জয় মার্কসের জয় বলে হ্যাপি এন্ডিং।  আর না থাকলে আরো কয়েকদিন এঁটে বসে থাকা।  টিকে থেকে ব্যাক করার রাস্তা খোঁজা।  পের্সিভেরান্স তো আছেই।  মরতে চাইছি , পারছি না বলে, তা কিন্তু নয়।  আমার আর কিছু করার নেই।  মানুষ সবথেকে কখন একা জানোতো -  যখন ভিড়ের মধ্যে সে একা।  যখন লক্ষ লক্ষ মুখ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে কিন্তু কেউ আমার জন্য ফিরে তাকাবে না।  তখন মানুষ একা হয়ে যায়।  আজ ঘর থেকে বেরিয়ে আমি পয়সা ওড়াতে পারি , দোকানের পর দোকান পেরিয়ে যাই।  এক একটা সবজির দোকানে এক একটা বাজার কিনতে দু চারখানা কথা আদান প্রদান করতে পারি।  কিন্তু তারা সবাই অপেক্ষা করে আমার মানিব্যাগে হাত যাওয়ার।  যেই গেছে সেই চুপ।  আর তাদের দরকার নেই।  আমার দরকার তো শেষ হয়নি , তবু ...।   কিন্তু এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি শেষ মুহূর্ত গুলো একদম আলাদা।  যারা রোগশয্যায় পরে মৃত্যুযন্ত্রনা ভোগ করে, তারা হয়তো ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখে। আমার কাছে এখনো শরীরটা কি সুন্দর লাগছে।  নাকের জায়গায় নাক , কানের জায়গায় কান , ফু দিলে চুল ওড়ে , ব্রহ্মতালু এখনো সাদা হয়নি, চামড়া কুঁচকোয়নি , চোখে ছানি নেই , এমনকি চোখে চশমাও নেই, চওড়া কাঁধ , স্থুল  পেশী সব বর্তমান।  কি সুন্দর করে সাজানো আমার এক্সটেরিওর।  আর তার মধ্যে ঢাকা পরে আছে আমার একাকিত্বে গুমরে ওঠা ধ্বসে যাওয়া মনটা -  যে থাকে এই শরীরের মধ্যে।  মহাকাশে ভারশূন্য অবস্থায় যে ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধি মানুষকে বোঝায় সে মানুষ,  সেই ইন্টেলিজেন্স আজ  রক্তাক্ত।  তার কাছে বাকি সব অপ্রয়োজনীয়।  কিন্তু তাও যেন বাঁচতে ইচ্ছা করে।  নতুন কিছু দেখার , নতুন কিছু চেনার ইচ্ছা এখনও মরে যায়নি।  ঘরভর্তি বই নেই বটে , তবে আই প্যাডের মেমোরি ফুল।  রোজই নতুন কিছু ঘটছে , কত খবর , কত কিছু।  যদি জানতাম মরণের পারে কি আছে তাহলে হয়তো মৃত্যু অনেক আগেই আসতো। এই বিরক্ত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হতো না।  ভেবোনা দোলাচালে ভুগছি।  উদ্যেশ্য স্থির।  কাল সকাল আর দেখতে চাইনা।  অন্তত এই নাম , এই শরীর নিয়ে। ব্লেড বার করে হাতে চালাতে চালাতে তবু যেন মনে হচ্ছে , কেউ আটকে নিক আমায় , কেউ একবার আটকে নিক।          












     

Monday, May 29, 2017

ফ্রী লিটিল লাইব্রেরী


আহা সত্যযুগ থাকলে কি ভালো না হতো । এখন তো শুধু  কি করে অপরের মারা যায় আর কি করে লোকেদের পেছনে বাঁশ দেওয়া যায় সেই নিয়ে সব সময় জল্পনা কল্পনা । সেই নচিকেতার গান আছে না , “সবাই সবার পেছনে আর সবার হাতে কাঠি” । এই সব ভাবতে ভাবতে প্রত্যেক দিনের মত হাঁটছিলাম । এই সুন্দর নধর ভুঁড়িটা এবার নামাতেই হবে । সামনেই ভাইয়ের বিয়ে, প্রচুর ছবি টবি উঠবে । নিজেকে ভালো দেখাতেই হবে । সময় ধরে রাখার এই একমাত্র জিনিস হচ্ছে ছবি । একটা কথা জানো তো, আমরা কারো মুখ মনে রাখতে পারিনা । আমরা ঘটনা মনে করি , আর মুখ বানাই । তাই আমরা তাদেরই মনে রাখি যাদের সাথে আমাদের কিছু না কিছু স্মৃতি আছে।  আর এই ছবি আমাদের স্বাভাবিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে। পুরনো ছবি ঘাঁটতে থাকো , দেখবে অনেক ভুলে যাওয়া স্মৃতি সামনে এসে পরবে ।
            

যাইহোক , রোজকার মত ফিটবিট হাতে লাগিয়ে আমি হাঁটা শুরু করেছিলাম সেদিনও। যেহেতু একই রাস্তা ধরে হাঁটাটা বিরক্তিকর তাই আমি প্রত্যেক দিন নতুন নতুন রাস্তা ধরতাম । মাঝে মাঝে হারিয়েও জেতাম, আর তারপর জি পি এসে ডায়রেক্সন টু হোম করতাম । শরীরের নাম মহাশয়, যা সয়াবে তাই সয় । কিন্তু ভুঁড়ি কমানোর জন্য এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে শরীর যেন কিছুতেই বুঝতে না পারে যে তাকে খাটানো হচ্ছে । একই রাস্তায় যদি রোজ হাঁটি তাহলে শরীর সেই রাস্তাটা কি করে কম এনার্জি খরচা করে অতিক্রম করতে পারে সেই ধান্দায় থাকবে । তাই এই প্রত্যকেদিনের নতুন নতুন রাস্তা অন্বেষণ।


            সেদিন একটা ট্রেল ধরে হাঁটছিলাম অনেক্ষন। চারপাশ জঙ্গলময় । মাঝে মাঝে ছোট ছোট সোঁতা পার করে জাচ্ছিলাম । বড় বড় কাঠবিড়ালি মাঝে মাঝেই আমার পায়ের ওপর দিয়ে বেরিয়ে জাচ্ছিল। আমার এই ছোট্ট শহর অবারন হিলস বেশ মিষ্টি । মিশিগানের জাঁকানো শীত বাদ দিলে সারাটা বছর বেশ ছিমছাম এই শহর। বেশ কিছু ট্রেল আছে, আমাদের মত ভুঁড়ি কমানোর উদ্যেশ্যে বারমুডা পরে ছুটে বেরানো লোকদের জন্য । এই ট্রেলটার নাম ক্লিনটন রিভার ট্রেল । প্রায় তের মাইল লম্বা এই ট্রেল অনেক কটা শহরের মধ্যে দিয়ে গেছে । তাই এক নাগাড়ে জঙ্গল নয় । মাঝে মাঝে রাস্তাও পেরোতে হয় । আর যখন ইচ্ছা , যেকোনো একটা গলি দিয়ে বেরিয়ে গেলেই নতুন শহর।


            যদিও দেখতে প্রায় একই রকম, কিন্তু প্রত্যেক শহর শুধু না , প্রত্যেক পাড়ারও এক একটা বৈশিষ্ট আছে । নতুন নতুন যখন এসেছিলাম তখন ব্যাপারটা ধরতে পারতাম না । কিন্তু অন্ধকারেও চোখ সয়ে যায় । এখন বেশ মজা লাগে, যেকোনো পাড়ায় ছড়িয়ে থাকা ইতিহাস আর বর্তমানের রঙ্গ দেখতে ।


            ট্রেল থেকে বেরিয়ে একটা বাঁক নিতে ঢুকে পরলাম একটা পাড়ায় । বাড়িগুলো দেখতে সব একই রকম । মানে এক সাথে বানানো বা এক সাথে দানে পাওয়া। আমাদের সল্টলেকের মতই কেস । অনেক বাড়িতে দেখলাম ভেটারেনের ফ্লাগ টাঙ্গানো আছে । বাড়িগুলোর ব্যাক ইয়ার্ড নেই । তার মানে নিতান্তই গরিব পাড়া । যদি এটা নিউ ইয়র্ক বা শিকাগো হতো তাহলে এগুলই মিলিয়ানিয়ার দের বাড়ি হতো । কিন্তু এটা একেবারেই ব্যাংকরাপট ষ্টেট ।তাতেও ব্যাক ইয়ার্ড নেই যখন তখন কিছুই নেই । গরীব কমিউনিটি ।

            এদিক ওদিক দেখতে দেখতে জাচ্ছি হঠাৎ নজরে পরল এই খেলনা বাড়িটার দিকে । দূর থেকে বেশ সুন্দর লাগছিল । মনে হয়েছিল কোনও বাচ্ছার জন্য বানানো হাইডিং প্লেস । কিন্তু কাছে আসতে আসতে, গায়ে চিপকানো লেখাটা পরলাম। “Free Little Library” । সামনে গিয়ে দেখলাম , ভেতরে বেশ কিছু বই আছে । ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকল । তারপর বইগুলো দেখলাম যথেষ্ট নতুন । কালেকশানও খারাপ নয় । বেশিরভাগই ক্লাসিক , কিন্তু হ্যারি পটার আর ডান ব্রাউন উঁকি মারছিল । আমি এদিক ওদিক তাকালাম। আমি কি নিতে পারি ? না মনে হয় । কমিউনিটির জন্যই হয়ত বানানো হয়েছে । যারা নেবে তারা হয়ত সবাই পরিচিত । আমি নিতে গেলেই হয়ত বাড়ির পেছন থেকে একটা ল্যাব্রাদর বেরিয়ে আসবে বা অন্তত ছবি তুলে নেবে আর পরে বাড়িতে সাবপিওনা আসবে ।



            কিন্তু আমার এই জিজ্ঞাসু মনটা কখনও বাঁধ মানে না । কিছু নতুন দেখলেই আমার এন্টেনা টং করে ওঠে। এরকম লাইব্রেরিতে তো যে কেউ বই ঝেড়ে দিতে পারে । যারা নিয়ে যাবে তারা নাও ফেরত দিতে পারে। ফ্রি ইস ফ্রি । আমরা তোঁ যা ফ্রি তা পরিমানের বেশি নিয়ে বাকিটা ফেলেও দি । তবে কি কেউ স্প্রিং ক্লিনিং এর নতুন ধান্দা বার করেছে , নাকি বই ফেলে দিতে গায়ে লাগে, তাই এটা এক প্রকার ডোনেট করার জায়গা । যাইহোক , ব্যাবস্থাটা কিন্তু বেশ ।


            অনেকবার ইতস্তত করে একটা বই হাতে তুলে নিলাম । আমি আশা করেছিলাম , বইগুলোর পাতা ছেঁড়া থাকবে, বা কেউ ডুডল করে থাকবে । লাইব্রেরিয়ান যখন বই ফেরত নেয়, তখন বই দেখে ফেরত নেয় শুধু মানুষের এই ধ্বংসাত্বক ব্যাবহারের জন্য । সুন্দর কিছু দেখলেই প্রচুর মানুষের মধ্যে সাদ্দাম জেগে ওঠে । একটু খুঁচিয়ে না দেখলে কারোর শান্তি নেই । কিন্তু এখানে তো লাইব্রেরিয়ানই নেই । কিন্তু আমাকে অবাক করে হাকেলবারি ফিন এর পাতাগুলো নিখুঁত ভাবে ছিল । এমনকি পাতার কোনাও কেউ ভাঁজ করেনি । তবে বেশ বোঝা জাচ্ছিল বইটা অনেক বার পরা হয়েছে । মাঝের বাঁধন আলগা ।


            বাকি বইগুলো দেখতে চোখে পড়ল হারপার লি এর টু কিল এ মকিংবার্ড । বইটা পরিনি , নাম শুনেছি অনেক । তাই তুলে নিলাম বাড়ি নিয়ে যাব বলে ।  কেউ আটকালো না , কেউ কুকুর ছেড়ে দিল না , আমি বিন্দাস বই নিয়ে ফেরত চলে এলাম ।

            এর পর বেশ কিছুদিন চলে গেল । ফ্রি এর বইও পরা হয়নি । ফেরতও দিতে জাওয়া হয়নি । হাঁটা কিন্তু থামেনি । রাস্তা বদলে গেছে । বেশ মাস খানেক পর হঠাৎ বইটার দিকে নজর পড়তে লজ্জা লাগলো । কিন্তু মনে হল , না ফেরত দেব না। আগে দেখে আসি । ফালতু মোটা বইটা এতটা রাস্তা বয়ে নিয়ে গিয়ে যদি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হয় । পাগল ছাগলের দেশ হঠাৎ মনে হয়েছে কেউ বানিয়ে দিয়েছে । হয়ত গিয়ে দেখব কেউ তুলে নিয়ে চলে গেছে । কিন্তু আমায় অবাক করে ফ্রী লিটিল লাইব্রেরি বহাল তবিয়তে সেখানে বর্তমান । স্মৃতি কুড়িয়ে বারিয়ে দেখলাম বইগুলো পালটে গেছে । কিছু তখনও এক আছে । কিছু পালটে গেছে ।


            ব্যাপারটা আমায় অবাক করে দিল । এরপর দু তিন দিন অন্তর অন্তর আমি ঢুঁ মারতে লাগলাম লাইব্রেরি তে । আর প্রত্যকবারেই দেখলাম বই পালটে জাচ্ছে । পুরানো বই ফিরে আসছে । নতুন বই অ্যাড হচ্ছে। বইগুলো জায়গা পরিবর্তন করছে । তার মানে আমি একা সেই লাইব্রেরির ভিসিটর নই । কিন্তু এতটাই ছিমছাম জায়গা যে আর কখনও কাউকে দেখলাম না বই দিতে বা নিতে ।


আমি আমার বই জথাস্থানে রেখে দিয়ে এলাম । আর ভাবতে লাগলাম , সত্যযুগ কি আছে । আমাদেরি প্যারালাল পৃথিবীতে । যে শহরে চুরির হার বেশি বলে ইনসিওরেন্স এর প্রিমিআম বেশি । সেই শহরেই এই ঘটনা আমাকে বেশ অবাক করে দিয়েছিল । না কি বই এখন চূড়ান্ত অবহেলিত জার কারনে কেউ হাত পর্যন্ত লাগাতে চায় না । কিন্তু সেটাও তো ঠিক কথা নয় । তাহলে বইগুলো পালটে যেত না । মানুষ যে কি বিচিত্র তা এই অভিজ্ঞতা থেকে ভালই টের পেলাম ।   

Saturday, May 27, 2017

আধ্যানের ডাইরি লেখার গল্প

আজ আধ্যানের বাবার জন্মদিন।  হ্যা, আজ থেকে ঠিক তিনশো পঁয়ষট্টি দিন আগে আধ্যানের একটা বাবা হয়েছিল।  আঠাশ ঘন্টা ধস্তাধস্তির পর যখন আধ্যান বেরিয়েছিল তখন বাবাই আধ্যানের আম্বিলিকাল কর্ড কেটেছিল।  ঠিক বেরোনোর কয়েক সেকেন্ড আগে এক সাথে আধ্যানের আর আধ্যানের মায়ের পালসরেট জিরো হয়ে যায়।  মেলার আর মেলানোর জন্য যেন দুজনেই রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করছিলো।  শেষমেশ যখন রক্তাক্ত এক পিন্ড গলা ফাটিয়ে পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো তখন তার বাবা দৌড়াদৌড়ি করছিলো ক্যামেরা নিয়ে।  ডাক্তার নার্সরা হাসাহাসি করছিলো টেক স্যাভির এক্সট্রিম নমুনাটাকে নিয়ে।  কিন্তু আধ্যানের বাবার কোনো হেলদোল ছিল না।  বমি উঠে আসা এমনিওটিক  ফ্লুইডের  গন্ধ চাপতে নাকে মাস্ক পরে আর পারফিউম স্প্রে করে সেও আঠাশ ঘন্টা আধ্যানের মায়ের সাথে ছিল ।  তার কাছে এই টিক টক করে চলে যাওয়া সময় ধরে রাখার একমাত্র উপায় তার ক্যামেরা।  তাই কে কি বললো তার বিশেষ এসে যায় না। 

আধ্যান জন্মানোর আগে সে বাণী বসুর অষ্টম গর্ভ পড়ছিলো। সেই সময় আধ্যান পেটের মধ্যে ঘুঁষি লাথি চালাচ্ছিল। আধ্যানের মায়ের পেটে হাত দিয়ে সে আধ্যানের খেলা অনুভব করতো তখন সদ্য পড়া অষ্টম গর্ভের ধারাবিবরণীর মতো তার মনে হয়েছিল আধ্যান কিছু বলতে চায়। একদিন আনমনে লিখতে শুরু করেছিল  " আমার ঘর ",  আধ্যানের ডায়েরির প্রথম পাতা।  পয়লা মে  দু হাজার ষোলো, আধ্যান আসতে তখনও সাতাশ দিন বাকি।  সেই লেখা যখন আধ্যানের মা কে শোনালো তখন আধ্যান যেন ,"ঠিক বলেছো" বললো। 

আধ্যানের জন্মের চল্লিশ দিন পর আধ্যানকে ছেড়ে  আধ্যানের বাবা দেশে ফিরে আসে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে অক্টবরের মধ্যে আবার ফিরে যাবে সে তার ছোট্ট আধ্যানের কাছে।  জে এফ কে এয়ারপোর্ট থেকে আবুধাবির ফ্লাইটে সে একে সবাইকে মাফ করে দেয়।  প্রথমেই মাফ করে বাবাকে।  কারণ বাবা না হলে বোঝা যায়না বাবার সমস্যা।  আঠাশ ঘন্টার ধস্তাধস্তি চোখে ভেসে উঠতে থাকে বার বার আর সে মাকে বৌকে আর যত মহিলা আছে সবাইকে মাফ করে দেয় একে একে।  দুর্বলতা গ্রাস করে মন, বুদ্ধি , চেতনাকে। 

মুম্বাইতে এসে শুরু হয় অন্য যুদ্ধ।  একনাগাড়ে পাঁচ বছর দেশের বাইরে থাকার জন্য দেশ তাকে ভুলে গেছে। তার আইডেন্টিটি তার জীবনধারণ সব গেছে পাল্টে।  চূড়ান্ত গতিতে দেশ যে ভাবে পাল্টেছে তার খবর সে রাখেনি। তাই মুম্বাইয়ের কঠিন বর্ষায় তার সারভাইভাল অফ দি ফিটেস্ট যুদ্ধ শুরু হয়।  আর সাথে শুরু হয় আধ্যানের সাথে ভিডিও চ্যাট।  সকালে ঘন্টাখানেক , বিকেলে ঘন্টাখানেক।  সময়গুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে থাকে।  একদিন আধ্যানের ছবি আর ভিডিও ঘাঁটতে ঘাঁটতে আধ্যানের উল্টো হাতে নাক ঘষার কথা মনে পড়ে যায়।  আর সে লেখে , "ভ্যাঙাচ্ছে "

চতুর্থ মাসের জন্মদিনে আধ্যানের সবথেকে বড় সমস্যা ছিল কমিউনিকেশন।  কেউ ওর কান্নার কারণ বুঝে উঠতে পারছিলো না।  তাই ওর কষ্ট বুঝে সে একটা ছোট লেখা লিখলো , "চার মাস" .

একদিন বসে বসে ভাবছিলো সে কি অসহায় তার ওই ছোট্ট আধ্যানের কাছে।  কেরিয়ারে এখনো পর্যন্ত ভালোই করছে।  শরীরের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অটুট।  রোজ সকালে উঠে টপ করে ওষুধ খেতে হয় না।  সুখী মানুষের নিদর্শন হিসেবে একটা ভুঁড়িও আছে।  কিন্তু ওই একটা ছোট্ট পাঁচফোড়ন সবাইকে কিরকম  নাচিয়ে চলেছে।  বলশালী পুরুষ আর রূপবতী নারীর দম্ভ নিমেষে চূর্ণ বিচূর্ণ করার ক্ষমতা রাখে একটা শিশু।  সেটাই আধ্যানেই মুখে লাগিয়ে সে লিখলো , "শোনো বাবা ও মা !!"

এই সময় শুরু হয় আধ্যানের খাওয়া নিয়ে সমস্যা।  না ঘুমালে সে দুধ খাবে না।  ডাক্তারও বলে দিয়েছে গ্রোথ কম।  ওদিকে একদিন যখন একাধারে আধ্যানের খাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তখন একদিন সে শুনলো আধ্যানের মা মাছের টক বানিয়েছে।  এদিকে সেদিনই আধ্যান আবার খাচ্ছে না।  কেন খাবে।  এতো সুন্দর সুন্দর খাবারের গন্ধর জায়গায় আধ্যান কেন শুধু দুধ খাবে।  ব্যাপারটা বুঝে সে লিখলো "খাবো না মানে খাবো না " . পরে যখন খিচুড়ি খাওয়া শুরু হলো তখন তার খুশি নিয়ে , "সান্ধ্র খাবার". যদিও সলিড ফুড আগেই দেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু অন্নপ্রাশন না  করলেই নয়।  কিন্তু অন্নপ্রাশনের দিন দেখা গেলো যে ধুতি দাদু নিয়ে এসেছে সেটা খাটো।  সেইসব নিয়ে লিখলো , "আমার অন্নপ্রাশন" . 

এর মধ্যে চলে এলো দূর্গাপূজা।  আধ্যানের প্রথম দুর্গাপুজো।  আর আধ্যানের বাবার প্রথম একা দুর্গাপুজো। সদ্য গজিয়ে ওঠা বন্ধুগুলো অনেকবার বললেও তার মন কিছুতেই পূজামণ্ডপে যেতে সায় দিচ্ছিলো না।  এবং শেষমেশ সারাটা পূজা সে ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিলো।  যেহেতু ওখানে উইকেন্ড পুজো,  অকাল বোধনের সেরা নমুনা। তাই উইকেন্ড এ পুজোয় আধ্যানের ছবি দেখে সে ভাবলো সবাইকে আধ্যানের তরফ থেকে শুভ বিজয়া বলে দি।  লিখলো "শুভ বিজয়া " .

এদিকে অক্টোবর পেরিয়ে গেছে অথচ ভিসার নামগন্ধ নেই। ওদিকে শাশুড়ির ফিরে  আসার সময় হয়ে আসছে।  দিশেহারা অবস্থায়  বিচার্য্য হলো আধ্যানকে ডে কেয়ারে দেওয়া হবে। পনেরোই ডিসেম্বর ভিসার ইন্টারভিউ।  হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি চলে আসবে সে।  শাশুড়ি চলে এলেন , আধ্যানকে ডে কেয়ারে দেওয়া হলো।  কিন্তু ব্যাপারটা সুখকর হলো না।  সহ্য হলো না আধ্যানের।  সমস্যা এতো গুরুতর হয়ে গেলো শেষে শশুর গিয়ে হাজির হলেন।  সমস্যা স্থিতু হলে একদিন বসে বসে আধ্যানের "ডে কেয়ার কড়চা" লিখলো সে। 

পনেরোই ডিসেম্বর ভিসা রিজেক্ট হলো।  শুরু হলো পরের ভিসার জন্য তোলপাড়।  চারপাশ থেকে বস্তা বস্তা তীর এসে পড়তে লাগলো আধ্যানের বাবার গায়ে।  মানসিক ভাবে এতো ভেঙে সে আগে কখনো পড়েনি।  এদিকে আধ্যান বড় হয়ে যাচ্ছে।  হামা দিচ্ছে।  মোবাইলের ওপাশটা কি সুন্দর।  বৌ বাচ্চা , ঘর , আসবাব আর অপর দিকে একটা নোংরা ওয়ান রুম কিচেন।  এতো ফ্রাস্ট্রেশানের মধ্যে আধ্যানের ডায়েরি তার কাছে এক অদ্ভুত পাওনা।  পুরানো ছবি ঘেঁটে ঘেঁটে স্মৃতি চটকে চটকে মিষ্টি মিষ্টি করে আধ্যানের কথা বলাটাই তার কাছে আধ্যানকে পাওয়ার মতো।  ছেলের পাসপোর্টের ছবিটা হাতে নিয়ে লিখেছিলো , "পাসপোর্টের দিনে" পরে একে একে বেরিয়ে আসে "আমি আমার মতো" "সর্দি কাশি " "মা বকেছে " .

দেখতে দেখতে এপ্রিল এসে গেলো আর তেসরা এপ্রিল শেষমেশ ভিসা পেলো সে।  চূড়ান্ত আনন্দে লাফিয়ে কেঁদে তখন আধ্যানের সাথে একাত্ম হয়ে লিখলো "বাবা আসছে" কিন্ত বিধি বাম।  ট্রাম্পের রুলের চক্করে দিনের পর দিন পিছিয়ে যেতে লাগলো তার যাওয়া।  শেষমেশ একদিন আধ্যানের মা বললো , "এট লিস্ট যে করে হোক আধ্যানের জন্মদিনে এস " রাত তখন দুটো কি মনে হলো যেনো আধ্যান কানে কানে একই কোথায় বলছে , "বাবা প্লিস জন্মদিনে এসো " . সকালে উঠে প্রথমেই সে লিখলো , "আমার জন্মদিনে এসো" . আধ্যানের মা কে পরে শোনানোর সময় কেঁদে ভাসিয়ে দিলো।  বয়েস অলসো ক্রাই। 

এরপর এক অদ্ভুত মানসিক অবস্থা হতে লাগলো তার।  অফিসে রোজ লড়াই ঝামেলা ঝগড়া করে যখন শেয়ার অটোতে সামনের সিটে বসতো তখন হঠাৎ করে কি হতো একটা আওয়াজ আসতো , "বাবা শোনো। ... "  তারপর আধ্যান যেন কথা বলতে আরম্ভ করতো।  আর রোজ রাত্রে এসে একে একে আধ্যানের ডায়েরি লিখে যেত সে।  মাঝ রাতে উঠে বেশ কয়েকদিন আলো জ্বালাতে হয়েছে তাকে।  মনে হতো আধ্যান ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বলছে , "কালকে যেটা বললাম সেটা লিখলে না তো। " এক অদ্ভুত হ্যালুসিনেশন সৃষ্টি হলো তার মনে।  পর পর লিখে গেলো "আমার নেমসেক", "মাদার্স ডে", "আমার ঘুম" , "ডাইপার তোলপাড়" , "ভুবন ভোলানো হাসি" , "এ শুধু আমাদের মধ্যে" .

সে যা লিখতো আগে সব ফেসবুকে পোস্ট করতো না।  ওলোটপালট করে যখন যা ইচ্ছা পোস্ট করতো।  কিন্তু সে এখন নিয়মিত পোস্ট করে যেতে লাগলো।  শুধু "আমার জন্মদিনে এসো" লেখাটা পোস্ট করেনি।  মনে ক্ষীণ আশা ছিল যে ও ঠিক জন্মদিনে পৌঁছে যাবে।  যেমন করে হোক।  কিন্তু হ্যালুসিনেশন বাড়তে লাগলো আর জন্মদিন কাছে আসতে লাগলো।  শেষে হতাশ হয়ে এই লেখাটাও পোস্ট করে দিলো।  ব্যাস তার পর থেকে আরো মাথা খারাপ হয়ে গেলো।  সারাদিন সে আধ্যানের ছবি আর লেখা নিয়ে বসে থাকতো।  কখনো আপডেট করছে , কখনো বানান ঠিক করছে , কখনো ছবি লাগাচ্ছে , কখনো লেখাগুলোতে যে কমেন্ট পড়েছে তার উত্তর দিচ্ছে। মনে তার অদ্ভুত পাগলাটে খুশি।  যেন সে দু হাত ধরে তার বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে আছে শব্দের মধ্যে দিয়ে।  

একদিন সকালে ধড়মড়  করে উঠে বসলো কি একটা স্বপ্ন দেখে।  ঘামে ভিজে গেছে সারা শরীর। রাতে ল্যাপটপ বন্ধ হয়নি।  চলছে।  আর আধ্যানের ছবি ওয়ালপেপার।  ব্রাশ করতে গিয়ে আবার সেই শব্দ কানের কাছে , "শোনো বাবা। ...." ছুটির দিন তাই ল্যাপটপ খুলে বসলো , এদিকে আধ্যান তখন বলে চলেছে। দুপুর বারোটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত ক্রমাগত সে লিখে চললো।  তিনটে লেখা এক দিনে বেরিয়ে এলো , "দন্ত বিকশিত" ,"ওই তারগুলো", "শুধু নো আর না" . শেষে রাতে আধ্যানের মায়ের পিং যখন এলো তখনও লিখে চলেছে।  কিন্তু পিং এর শব্দে সেন্স ফিরে পেয়ে সে বুঝতে পারলো ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না।  আধ্যানের হ্যালুসিনেশন কিন্তু বেড়েই  চললো।

এমন সময় হঠাৎ এক সাংঘাতিক খবর আধ্যানের বাবার অন্থস্থল খেয়ে ফেললো।  তার ফুলের মতো সাত বছরের ভাগ্নে হঠাৎ শ্বাসনালীতে খাবার আটকে মারা গেলো।  একদম ভেঙে পড়েছিল সেদিন।  কিন্তু এই শকে আধ্যান চুপ করে গেলো।

আজ আধ্যানের জন্মদিন।  কিন্তু তার বাবার কাছে তার জন্য লেখার মতো কিছু নেই।  পৃথিবীর ওপ্রান্তে ভিডিও চ্যাটে তার কেক কাটা দেখে খুব তাকে ছুঁতে ইচ্ছা করছিলো।  কিন্তু ফোনের দেওয়াল ভাঙার উপায় নেই।  এক ভয়ঙ্কর অসহায়তায় তার বাবা আজকে আবার খুলবে সব ছবিগুলো , সব ভিডিওগুলো , আবার দেখবে , তার একমাত্র সাহারা এই চিত্র ও চলচিত্র গুলো।  যখন সে ছেড়ে এসেছিলো তখন আধ্যান ঘাড় সোজা করতে পারতো না, এখন সে হেঁটে বেড়ায়।  কিসের শাস্তি যে সে পাচ্ছে ভগবানই জানে।  সব দুঃখের মধ্যে একটাই সুখ, প্রতীক্ষার অন্ত এসে গেছে।  আর বেশিদিন নেই।  বাবা আসছে , আধ্যানের বাবা যাচ্ছে তার কাছে, খুব শিগগির, সামনের মাসেই।     

আধ্যানের ডাইরির সব পাতা এক সাথে
                ) আমার ঘর
                                ) ভ্যাঙাচ্ছে
                               ) চার মাস
                               ) শোনো বাবা মা !!
                               ৫) খাবো না মানে, খাবো না
                               ৬) শুভ বিজয়া
                               ৭) মা বকেছে
                               ৮) সান্ধ্র খাবার
                               ৯) পাসপোর্টের দিনে
                               ১০) সর্দি কাশি
                               ১১) আমি আমার মতো
                               ১২) আমার অন্নপ্রাশন
                               ১২) ডে-কেয়ার কড়চা
                    
                               ১৩) বাবা আসছে
                               ১৪) কি জ্বালাতন
                               ১৫) শুধু আমাদের মধ্যে
                               ১৬) ভুবন ভোলানো হাসি
                               ১৭) ডাইপার তোলপাড়
                               ১৮) আমার ঘুম
                               ১৯) মাদার্স ডে
                               ২০) আমার নেমসেক
                               ২১) আমার জন্মদিনে এসো
                               ২২) শুধু নো আর না
                               ২৩) ওই তারগুলো
                               ২৪) দন্ত বিকশিত