বাবা আসছে। ইয়ে -এ -এ-এ-এ। কাল রাতে আমি ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে উঠে দেখছিলাম। মা বেশ অস্থির। এমনিতেই খুব একটা শান্ত মহিলা তিনি নন। কিন্তু কাল যেন রাতে বেশিই ছটফট করছিলো। হঠাৎ একটা ফোন বেজে উঠলো। ওদিক থেকে কিছু একটা কথা এলো আর মায়ের একটা বিশাল
নিঃশাস। কি শান্তি ছিল মুখে। ফোন রেখে আমায়
বেশ কিছুটা চটকে বলল , ' বাবা আসছে রে ' . মানে বাবার ভিসা শেষমেশ ডান।
আমি তখন ঘুমের ঘোরে। বিশেষ পাত্তা দিইনি। কিন্তু সকালে উঠে দেখি ঘরের হওয়া পাল্টে গেছে। মা গুন্ গুন্ করে গান গাইছে। দাদুর হাসি হাসি মুখ। সবাই খুশি বাবা আসার খবরে। আমি তো সবথেকে বেশি খুশি।
আমি একটু টেনশনেও আছি। আমার কম্পিটিটার আসছে।
তবে কম্পিটিশন না থাকলে কি আর আগে এগোনো যায়।
এই লোকটাই আমাকে প্রথম মায়ের থেকে আলাদা করেছে। ব্যাটা করে আমার ফুড সাপ্পলাই কেটে দিলো। উইদাউট এনি ইন্টিমেশন! তাও কাঁচি দিয়ে! টিকটিকির
ল্যাজের মতো। উফফ ভাবলেও ভয় লাগে। কি নৃসংশ। কিন্তু না , ব্যাপারটা বেশ ভালোই করেছিল। নাহলে এই ফ্রি ভাবে ঠিক বাঁচা যেতো না। কিন্তু এখন একটাই ভয়, মায়ের থেকে আলাদা করে দেবে
না তো। কিন্তু সেটাই তো কম্পিটিশন। আমার থেকে বেশি কি আর মা কে ভালোবাসতে পারবে। আমি
যেরকম করে মায়ের সাথে ঘুমোই সেরকম সজাগ ঘুম কি বাবার। কি জানি।
তবে মনে আছে , যখন আমার সাথে ঘুমোতো , তখন আমি বাচ্চা। বাবার এক হাতের সমান। পেটের ভিতর ঠিক যেরকম গরম
ওম হয়ে থাকতো। বাবা ঠিক সেই ভাবে ওম করে জড়িয়ে
ধরতো। আর ব্যাস দুজনেই পোঁদ উল্টে ঘুম। মা আবার একটা ছবি তুলে রেখেছে। আমাকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিলো না। হেব্বি একটা লুকোনোর জায়গা আছে বটে।
বাবাটা বেশ বড়সড়ো , যাকে বলে গোদা। আর আমি বড় হয়েছি বটে। তবে ওরকম জলহস্তী নই। হিউমান ডেলিকেসি , স্মার্ট এন্ড এলিগেন্ট। বাবার গলাটাও বেশ ভারী। আমারও অনেকটা ওরকম , কিন্তু একটু কম। আমারটা এখনো সুইট এন্ড সফ্ট। সবাই বাবার সাথে আমায় তুলনা করে। আমি নাকি বাবার মতো দেখতে। সব চোখে ন্যাবা। আমার এই সুন্দর সোনা গলানো রং আর বাবা আলকাতরা। কি যে বলে না।
ছাড়ো তো , এই চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ নয়।
আজ থেকে তিরিশ বছর পর হবে , যখন আমার বয়স বাবার মতো হবে।
এই বাবা যখন ছেড়ে চলে গেলো আমাকে আর মা
কে , তখন আমার মোটে দু মাস বয়স। বাবার বন্ধুরা
একটা বসার চেয়ার দিয়ে গেছিলো। সেটাতে তখন আমি
ঘাড় গুঁজে বসে থাকতাম। ঘাড় সোজা হয়নি তো ,
তুলতেও পারতাম না। সেই চেয়ার আমি এখন তুলে
ফেলে দিই। বাবা আবার গান গেয়ে আমার কান্না
থামানোর চেষ্টা করতো। পুরুষ জাতি সত্যি অসহায়।
এক ফোঁটা দুধ হয়না। হলে এটলিস্ট ওই
হেঁড়ে গলায় তারস্বরে বেতালা চিৎকার করতে হতো না। কিন্তু চেষ্টা তো করতো।
বাবা মা কে বলে এই একটা জিনিস যেন আমি
বাবার কাছ থেকে নিই। পার্সিভেরান্স , টিকে
থাকা। সত্যি এতদিন হয়ে গেলো , আমায় শুধু ফোনে
দেখতে পায় , কিন্তু দেখলেই চেষ্টা করে আমাকে হাসানোর। বাকিরা হলে ছেড়ে দিতো। কিচ্ছু করার দরকার ছিল না। আমার সামনে এক লক্ষ অঙ্গভঙ্গি করেই যেত করেই যেত। আদ্ধেক ভালো লাগতো না। কিন্তু যখন একটা কোকিলের মতো শীষ দিতো। কি ভালো লাগতো আমার। আর আমি আমার হাসির প্রসাদ দিয়ে দিতাম। বাবাও হাসতো।
আর কয়েকদিন আগেই আমায় ফোনে ফোনেই হাততালি শিখিয়েছে। বাবা মাঝে মাঝেই বলে ছেলে
যদি আজকে হাততালি দে তাহলে আমার দিন ভালো যাবে।
আর মা চেষ্টা করতে থাকে , কি ভাবে আমায় হাততালি দেওয়ানো যায়। কিন্তু আমি তো শুধু বাবার দেখে কপি করি , আর নিজের
মনে একলা থাকলে হাততালি দিই। একদিন বাড়িতে
সবাই এসেছিলো। আয়ুসী , অর্ধন , ওদের বাবা মা। যখন ওরা বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছিলো। অর্ধন আর আয়ুষীর বাবারা যখন ওদের জ্যাকেট পরিয়ে
দিচ্ছিলো , তখন আমি নিজের মনে হাততালি দিচ্ছিলাম।
এই কথাটা বাবাকে মা বলে মায়ের কি কান্না , বাবারও চোখ ছলছল। বাবা তো আর কাঁদতে পারে না।
বাবা আমার জন্য খেলনা কিনেছে, ওখান থেকে। যদিও এখনো হাঁটছিনা , বাবার জন্যই অপেক্ষা করছি। তাই বাবা আমার জন্য প্যাঁকপ্যাঁক জুতোও কিনেছে। মা বাকি কিছু আনতে বারণ করে দিয়েছে, জানে তো বললেই
এখন এক গাদা ফালতু জিনিস কিনে হাজির করবে যার কোনো দরকার নেই। বাবা একটু বেশিই খরচে। মায়ের মতো গুছোনো নয়। মা কিরকম খেলনা গুলো ঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখে। যাতে
আমি আবার একটা একটা করে ছুড়ে ফেলে দিতে পারি।
মা বলে তোর বাবাও সব এদিক ওদিক ছুড়ে ফেলে রাখে। ঠিক আছে ঠিক আছে সব ছেলেই এরকম হয়।
বাবা যেদিন চলে গেলো তারপর থেকে সবথেকে
বেশি কষ্ট হয়েছে মায়ের। বাবা তো অসুরের মতো।
মা কি পারে। এদেশের নিয়ম মতো কার সিট্ ছাড়া
আমার মুভমেন্ট বন্ধ। একদম গণতান্ত্রিক ইন্সাল্ট। তবু ঠিক আছে সেফটি মেসার হিসেবে আমি মেনে নিলাম,
কমফোর্টেবলে তো বটে। কিন্তু আমার সিংহাসনটা
খুব ভারী। দোতলা থেকে মা একবারে নামাতে পারতো
না , প্রথম দিকে। এখন বাধ্য হয়ে অভ্যেস করে
ফেলেছে। মা তো মা ই হয় না। এখানে আবার এতো বেশি বেশি জিনিস কিনতে হয়। সেই ভারী ভারী বস্তা মা তুলে তুলে নিয়ে আসতো। সকালে যখন আমাকে ডে কেয়ারে রেখে অফিস যেত। তখন আগে আমায় একটা চেয়ারে বসিয়ে বাবাকে সামনে বসিয়ে
রেখে যেত। বাবা তখন নানা অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে
ভোলানোর চেষ্টা করতো। মা প্রথমে নিচে গিয়ে
গাড়িতে আমার ব্যাগ , মায়ের ব্যাগ রেখে আসতো , আর গাড়িতে হিটার চালিয়ে আসতো তার পর আমাকে
নিয়ে যেত। আমি গিয়ে গরম গাড়ি পেতাম। বেশ লাগতো।
একবার ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। বাবা
ডিসকানেক্ট হয়ে যায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। বাবা কিন্তু তখনি মা কে ফোন করে দিয়েছে। মা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দেখে আমি ভোঁদার মতো বসে আছি। আবার বাবা ও হতেই একটা হাসি দিয়ে সব ঠান্ডা করে
দিলাম।
বাবা যখন এখানে ছিল বাবা কারো কথা শুনতো
না। সবাই কত রাগ করেছে বাবার ওপর। বাবার দোষ ছিল এই যে আমাকে চটকাতো। সবাই বলতো নোনা গাযে ঘাঁটতে নেই। আর বাবা আমার সারা গায়ে হাত বোলাতো। আমার হেব্বি মজা লাগতো। সবাই বলতো এতো চটকালে ছেলে বাড়বে না। আহাম্মকগুলোর মুখ বন্ধ করে দেখো আমি বাড়ছি বাবা। বাবা কারো কথা শোনেনি যখন আমাকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে
গেছিলো , তখনা আমার দেড় মাস বয়স। সবাই হা হয়ে
গেছিলো। বাবা বলেছিলো কিচ্ছু হবে না। আমাকে জড়িয়ে সরিয়ে বেশ সুন্দর নিয়ে গেছিলো। আর আমিও প্রথম সমুদ্র দেখতে পেয়েছিলাম। কি বিশাল তার চেহারা। কত জল।
কত মানুষ।
মা যখন বাবার সঙ্গে ছিল তখন ব্যাপারটা
কত সুন্দর ছিল। কখনও বাবাকে পাত্তা দিতাম কখনো
মা কে। দুজনে সেই নিয়ে ঝগড়া করতো। বাবা চলে যাওয়ার পর মা দিন দিন খিঁচিয়ে যেতে লাগলো।
মাঝে মাঝে তো আমার ওপরেও চিৎকার করতো। তাই
নিয়ে তো আমার ডায়েরিও লেখা আছে। বাবা আর মায়ের
কম্বিনেশন বেশ সুন্দর। একজন সকালে ঘুমোয় একজন
রাতে। দুজনে একসাথে থাকলে কত ভালো হতো। এই একা একা মায়ের ঘর , বার , দোকান - বাজার আর সবথেকে
বোরো কথা আমাকে সামলানো কি কঠিন সে তো আমি জানি।
কিন্তু আমি আমার এই যৌবন আমি স্যাক্রিফাইস করতে পারবো না। এখনই তো আমার খেলাধুলার সময়। যেমন বাবার সঙ্গে থাকোনি তেমন ভোগো।
বাবা মার ঝগড়া দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেশ ভয় হয়। বাবাকে ছেড়ে থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে
গেছে , কিন্তু ইচ্ছা তো হয়। সবার বাবা যেরকম
সবার সাথে খেলে, আমার বাবার সাথে খেলতে তো আমার ইচ্ছা করে। মা ও খেলে কিন্তু বাবা স্বজাতি। কম্পিটিশন থাকতে পারে , কিন্তু সমস্যা গুলো তো বাবাই
ভালো বুঝবে আমার। বাবা এখনো সেই ফোনটা চালিয়ে
যাচ্ছে জেটাতে আমি গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে দিয়েছিলাম। অপবিত্র ইন্টারনেট তাই মাঝে মাঝেই ঢুকতে পারে না
বাবার ফোনে। সেই গল্প অন্য একদিন। সেই আধভাঙা ফোন নিয়েই বাবা আমার কাছে দ্বিমাত্রিক
জেক বলে ২D .
বাবা যখন ছেড়ে গেছিলো , তার পর থেকে আমার
ঘাড় শক্ত হয়েছে , আমি উল্টাতে শিখেছি , আমার
হাসি বেরিয়েছে , আমার মাড়ি শক্ত হয়েছে , আমি বসতে শিখেছি, হামা দিতে শিখেছি , ধরে ধরে
হাঁটতে শিখেছি। নানা ভাবে আওয়াজ করে ডাকতে শিখেছি , রাগ দেখাতে শিখেছি , টিভি দেখতে শিখেছি , আর এই বড় বড় লেখা
লিখতে শিখেছি। বাবা শুধু ফোনের ওপারে বসে গালাগালি
শুনেছে।
আমি জানি একা থাকার কি কষ্ট। মা যখন আমায় কিছুক্ষন একলা রেখে চলে যেত কি ভয় লাগতো
আমার। মনে হতো কেউ যদি ধরে নিয়ে চলে যায়। বাবা
তো নেই। মা ও যদি আমায় ছেড়ে চলে যায়। সিঁটিয়ে যেতাম ভয়ে। বাবা কিন্তু একই আছে। কতদিন হয়ে গেলো। যদিও ওটা বাবার নিজের দেশ , তবুও আমি যেখানে নেই
সেখানে আনন্দ নেই। আমি জানি ভিসা করা সহজ ব্যাপার
নয়। কিন্তু শেষমেশ বাবা সেটা করে ফেলেছে। আর বেশি দিন নয়। আমার আনন্দ আর বাবার আনন্দ দুটো মিলিয়ে আমরা মা
কে চুবিয়ে দেব। কম্পিটিশন থাকবে তবে জানি বাবা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আপপুলিশ বলে ছেড়ে দেবে।
মনে তাই খুব খুশি। ইয়ে - এ -এ -এ -এ
-এ -এ। বাবা আসছে।
---------------------------------------------------------------------------------------
আগের ডায়েরির পাতা গুলো
---------------------------------------------------------------------------------------
আগের ডায়েরির পাতা গুলো
- ডে-কেয়ার কড়চা
- আমার অন্নপ্রাশন
- আমি আমার মতো
- সর্দি কাশি
- পাসপোর্টের দিনে
- সান্ধ্র খাবার
- শুভ বিজয়া
- খাবো না মানে, খাবো না
- শোনো বাবা ও মা !!
- চার মাস
- ভ্যাঙাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment