Sunday, November 20, 2016

অর্থ সঙ্কট


সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে বাই হাত পাতলো।  ভুলেই গেছিলাম মাইনে দিতে হবে।  ঘুম ঘুম চোখে মানিব্যাগে হাত দিতে হা হতোস্মি।  নেই নেই কিছু নেই , তবুও যা আছে কিছু বলতে যা বাঁধা নেই।  দু নয়নে ভয় আছে , মনে সংশয় আছে।  আর তিনটে ক্রেডিট কার্ড আছে দুটো ডেবিট   কার্ড আছে।  একাউন্ট এ গুচ্ছ টাকা আছে।  কিন্তু বাই কে মাইনে দেওয়ার মতো পয়সা নেই।  কত টাকা।  হাজার ওনলি।  গ্যাঁটে কত।  একশো কুড়ি। সামনে খরচা , শেয়ার অটো ২০ টাকা আসা , ২০ টাকা যাওয়া , একটা সিগারেট তেরো টাকা, সাথে একটা চুটকি।  বাকি আপাতত কার্ড এ চলে যাবে।  


হাত কচলিয়ে মুখ চুকিয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে বাই এর "বরা আদমি" বললো , "একাউন্ট নাম্বার দিলে ট্রান্সফার করে দিতে পারি। নাহলে দেরি হবে পয়সা দিতে।" বাই বেশ কিছুক্ষন হতভম্ব র মতো তাকিয়ে থেকে বললো , "বাদ মে দেনা সাব।  চলেগা।" এমন দুচ্ছাই খুব মানে লাগলো।  এমনিতেই হাত পাতা ধার নেওয়া অভ্যেস নেই।  তার ওপর এরকম। নাঃ , বললাম ,"কেন একাউন্ট নম্বর নেই?" কথোপকথনের সারাংশ এই দাঁড়ালো। ম্যাডামের একাউন্ট আছে।  কিন্তু সে তার ব্যাপারে কিছু জানেনা।  তার স্বামী ওটা চালায়। এখন আমার বাড়ি আর কিছু বাড়ির মাইনে সে একাউন্ট এ দেয় না।  তার নিজের হাতে রাখে কারণ নেশাখোর বর যদি সব টাকা কোনোদিন কোনো মেয়েছেলের হাতে তুলে দেয় তাহলে তার আর কিছু বাঁচবে না।  তাই পরে দেওয়া চলবে , "সাব আপ পে ভারোসা হ্যায়  " প্রথম চাঁটি , " আপ কাহা ভাগোগে " দ্বিতীয় চাঁটি "পাইসা মিল জায়ে ফিরে দে দেনা।" তৃতীয় চাঁটির পর মলম , "তিনকা তিনকা জোরতে হ্যায় সাব , চোর থোরি হ্যায়।"


নাঃ খুব কষ্ট লোকেদের।  আমাদের মতো শিক্ষিত ক্রেডিট কার্ড ওয়ালা মানুষের আর কি কষ্ট।  অর্ধেক তো কার্ড swipe করলেই হয়। শুধু পয়সা বেশি দিতে হয় আর কি।  ম্যাকডোনাল্ড আর পিজা হাটে নিজেকে বেচে দেওয়া মানুষদের আর কি সমস্যা। কিন্তু আমার বেশ সমস্যা । আমার ওই বিদেশি খাদ্য বিদেশেই পছন্দ । দেশে আসলে আমার রোডসাইড ধুলোমাখা খাবার আমার ভিটামিন ডি বাড়িয়ে দেয়। তাই আমার অধিকাংশ খরচাই খুচরোতে । একটু বিস্তারিত বলি ।

 আমি যেখানে থাকি সেখানে দুটো বিশাল বড় মল বা শপিং চেম্বার আছে। দেখতে শুনতে ভালো সব কিছু ঝকঝকে। যারা আসেন তাদের গায়ে সুগন্ধ। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক করার সামগ্রি পাওয়া যায়। কিন্তু দুইখান আপত্তি । টাটকা আর খরচা । 

বেশ কদিনের বাসি সবজি পাওয়া যায়। মানছি গরম কালে ফুলকপি,  শিতকালে এঁচোর পাওয়া যায় । কিন্তু আমার শীতকালে আম আর গরমকালে পালং শাক খেতে মোটেও ভালো লাগে না । আর সেই কারনে আমায় ছুটতে হয় ঠেলাওয়ালার কাছে। সময়ের সবজি নিতান্ত কমদামে পাওয়া যায় । হ্যাঁ একটু বেচে নিতে হয় বটে। তবে কানা বেগুন , বা ধ্বসা আলু আপাতত বুঝতে পারি, তাই আমার বিশেষ আপত্তি নেই। 

আর দ্বিতীয় হল এমআরপি। মল মানেই এমআরপিতে জিনিস বিক্রি করবে। মাঝে মাঝে নানা রকম সেল দিয়ে পুরনো স্টক ক্লিয়ার করা ছাড়া সব সময় ম্যাক্সিমাম রিটেল প্রাইসেই জিনিস্পত্র কিনতে হয়। কেন কিনব ? যখন পাড়ার দোকান আমাকে কম লাভ রেখে পাইকিরি দরের থেকে একটু বেশি দামে জিনিস বিক্রি করছে।তর্কের খাতিরে লোকে বলে ওঠে কেন ক্রেডিট কার্ডে তো এখন পয়েন্ট দেয়। ক্ষমা করে দিতে হবে, কারন অঙ্ক খুব কঠিন।

এই হল আমার সমস্যা। এর সাথে জদিও আরও আছে , গোয়ালার দুধ, অটোর ভাড়া , বারো টাকার বড়াপাও , কুড়ি টাকার ফুচকা, ষাট টাকা ডজন ডিম , বেল্ট এ ফুটো করানো , জুতোপালিশ, ছাতা সারানো , তিরিশ টাকার ধোসা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যদি। মোদ্দা কথা হল একটু ধুলো , গন্ধ সহ্য করে নিলে যদি মানিব্যাগে পয়সা আর ফ্রেশ খাবারের আনন্দ মজুদ থাকে তাহলে কেন আমি মল এ ঢুকব । 

                তাই আমার পুরোটাই ক্যাশে যায়। পে টি এম এর থেকে  এটিএম  আমার কাছে বেশি শিহরণ জাগায়। কিন্তু এমন বাঁশ খেয়েছি যে আর কিছু করার নেই। সেই বাঁশ নামাতে গিয়ে টুক টুক করে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম সেই এটিএম এ যেখানে আমি গত এক বছর ধরে যাই । বন্ধ । সামনে নো ক্যাশ এর বোর্ড ঝোলানো । ঠিক আছে, নো প্রব্লেমোস । এখন তো যে কোনও এটিএম থেকে টাকা তলা যাবে । আশায় জল, গোবর , নাদি ঢেলে পরের পাঁচটি এটিএম এ একই উক্তি। একটা এটিএম এর সামনে কিছু লোকের জটলা দেখে দাড়িয়ে পরলাম। কি ব্যাপার? ক্যাশ আসছে । বন্যা পীরিত এলাকায় শুকনো খাবার আসছে । সবাই উত্তেজিত । আমিও । গল্পে কিছুক্ষন ভিড়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম, পাঁচ মিনিট আগেই শেষ লোকটি টাকা তুলেছিল। পাঁচ মিনিট। আবার প্রশ্ন করলাম পাঁচ মিনিট । ওনলি পাঁচ মিনিট? ‘কেন দাদা বিশ্বাস হচ্ছে না?’ না সময়টা বিশ্বাস না করার মত কিছু নেই । আমি অবাক লোকের ধৈর্য দেখে। এরাই সেই লোকজন যারা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা না করার জন্য প্রানপনে হর্ন বাজায়। আর এখন এরা আরও এক ঘণ্টা অপেক্ষা করবে এটিএম লোডিং এর জন্য। সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই মোদীত্ব । 

                আমার অপেক্ষা করা সম্ভব নয় । কারন আমার বিবেচনা বলে যে এই ক্যাশ এর আগমন যে কোনও সময়ে বিলম্ব হয়ে যেতে পারে। তাই ডেলিপ্যাসেঞ্জের এর মত শ্রীরামপুর পর্যন্ত তো চলে যাই, ওখান থেকে না হয় পরের ট্রেনে চন্দননগর। কিন্তু একের পর এক এটিএম ঘুরেঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেলাম । আমার আগেই এই এটিএম ট্যুরিজ্ম লোকে করেছে বুঝতে পারছি। কারন আমার পেছনের আর সাম নের কিছু লোক কে প্রতিটা এটিএম এই দেখতে পাচ্ছিলাম । 

                গলা শুকিয়ে কাঠ, জদিও সময়টা শীতকাল । কিন্তু মুম্বাই কি আর শীত জানে। তাই একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক নিয়ে কান খাড়া করলাম। এখন যেখানে যা গ্যান আর নতুন খবর পাওয়া যায় তাই ভালো। নানা মুনির নানা মত থেকে মোটামুটি এইটা বুঝতে পারলাম যে এটিএম এ আট লাখ আশি হাজার টাকা একবারে লোড করা যায়। টার মানে চারশো চল্লিশ লোককে এক বারে টাকা দেওয়া যেতে পারে। হিসেব মত দু ঘণ্টায় একটা এটিএম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে আর পরের লোড সবসময় সময় মেনে হচ্ছে না । অন্তত তেইশ হাজার কোটি টাকার দরকার আর মাসে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ছাপানো সম্ভব নয়। হিসেব পরিষ্কার , চোখ বড়বড় , ঘাম ছুটছে , আমার কি হবে। 

                আরে দাদা ব্যাংক থেকে তুলে নিন। ইসস কি বোকাই না আমি। ব্যাংকে গেলেই তো হবে। উইথড্রল স্লিপ দিয়েই তো সপ্তাহে চব্বিশ হাজার তুলতে পারবো । এক বার তুল্লেই তো অনেকদিন চলবে । মেয়ের বিয়ে দিতে এখনও বেশ দেরী । মোটামুটি বীরদর্পে গিয়ে একটা ল-অ-অ-ম্বা লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম । চুপসে গেলাম । এতক্ষন । কিন্তু শিওর শট । তাই অপেক্ষা করতে অসুবিধা নেই। অন্তত একশ লোকের পেছনে লাইন। ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করে নিয়েছিলাম যে এটা ব্যাঙ্কের লাইন না এটিএম এর। লোকটি পানে আটকানো বন্ধ মুখ না খুলে বন্ধ এটিএম এর দিকে আঙ্গুল দেখিয়েছিলো । আমি নিশ্ছিন্ত মনে লোক দেখছিলাম । কেউ কেউ বই নিয়ে এসেছে, কেউ কেউ ইবুক রিডার , বাকীরা মোবাইলে ঘাড় ঝুনিকিয়ে আছে । দেদার সেলফি  আর হ্যাশ ট্যাগিং চলছে। কারো মুখে বিরক্তি নেই । ভবিতব্য মেনে কি শান্ত হয়ে লোকে দাড়িয়ে আছে। 

                সবাই দেখলাম একটা করে স্লিপ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে । আমি আবার অবাক। অটো থেকে নেমে বড় ব্যাগ থেকে ছোটো ব্যাগ বার করে টার মধ্যে গোপন চেন খুলে যারা পাঁচশো টাকার নোট বার করে খুচরো চাইতো তারা আগে থেকে রেডি হয়ে থাকছে। ভাবা যায়। দেখলাম একটা টুল নিয়ে এক ভদ্রলোক বসে আছে, হাতে কিছু স্লিপ বই। পেছনের লোককে বলে লোকটার কাছে এগিয়ে যেতে একটা স্লিপ কেটে এগিয়ে দিল , কোনও কথা নেই । হাতে নিয়ে দেখি এ তো ডিপোসিট স্লিপ । জিজ্ঞেস করতে বুঝতে পারলাম যে লাইনটা নেওয়ার নয় দেওয়ার । ততক্ষনে আধঘনটা কেটে গেছে। আমার প্রশ্নোত্তরে বেশ কিছু লোকের মনরঞ্জন করে আমি সোজা চলে গেলাম দরজায়। কোনও লাইন নেই। তাজ্জব। 

                গেটকিপার আমায় দিব্যি ঢুকিয়ে দিল। আমি সোজা  ডিপোসিট কাউনটারে গিয়ে উইথড্র  স্লিপ ভরতে লাগলাম । চব্বিশ হাজার ভরে , স্লিপটা এগিয়ে দিতে নিতান্ত এক্সপ্রেসনলেশ ভঙ্গিতে মাদাম বললেন , “চলছে না। চলবে না।” কেন ? শুধু চেক । আমার তো চেক নেই । চেক নেই?  এ আবার কি? হ্যাঁ নেই । যখন কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দিয়েছিল কম্পানি। চেক তো দেয়নি। আর লাগেও না কোথাও। তাই নাকি । অবজ্ঞা লুফে নিলাম। পরে অ্যাপলাই করেননি কেন? সরি । এখন চেক ছাড়া হবে যদি এই ব্রাঞ্চে অ্যাকাউন্ট থাকে। তাও ম্যানেজার এর আপ্প্রভাল লাগবে। অ্যাকাউন্ট কথাকার।  কলকাতার । পাল্টে নিন। সে তো অনেক সময় লাগবে। হ্যাঁ সাত থেকে চোদ্দ । এখন জদিও বলা জায়না কতদিন লাগবে। তাহলে উপায়। অ্যাড্রেস বদলে নিন। আর চেক অরডার করে দিন। তিন চার দিনে চলে আসবে। কি করে করা যাবে অ্যাড্রেস চেঞ্জ। ফর্ম ভরুন আর অ্যাড্রেস প্রুফ দিন। অ্যাড্রেস প্রুফ বলতে রেনট এগ্রিমেন্ট চলবে তো ? হ্যাঁ, রেজিস্ট্রেশান করানো আছে তো? না, নোটারাইস । তাহলে হবে না। কোনও বিল আসে আপনার নামে? হ্যাঁ। ইন্টারনেটের । এমটিএনএল ? না টাটার ইন্টারনেট। চলবে না । গভরমেন্ট অ্যাড্রেস প্রুফ লাগবে। তাহলে উপায়। 

                আরও দুচার উপায় লজ্জাজনক ভাবে ‘না’ বলে , শেষমেশ বেরিয়ে এলাম । আবার পরের এটিএম এর সন্ধানে !!!!!!!

      


No comments:

Post a Comment