Wednesday, July 17, 2013

খাই খাই চন্দননগর -- Part 1

সময়টা বেশ তারাতারি গড়াচ্ছে। আমিও গড়িয়ে চলছি সময়ের সাথে সাথে। সব কিছু ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। পেটে লাঠি মারলেও এক কালে দু কথা ইংলিশ বেরোত না। আজ পেটের তাগিদেই সেই পেট থেকেই বেরিয়ে আসছে অতিরিক্ত "র" সমন্নিত বিদেশী বুলি। প্লিট দেওয়া টেরিকট ছেড়ে জিন্স এ দিব্যি জমিয়ে নিয়েছি নিজেকে। মফঃসল এর ছেলের ভয় ভয় চোখে কলকাতার বড় রাস্তা পেরোনোর ভীতি দুরে সরিয়ে দিব্যি এক্সেলারেটরে দিচ্ছি চাপ, পেরিয়ে যাচ্ছি সয়ে সয়ে মাইল। শুধু একটা জিনিস কিছুতেই পাল্টাচ্ছে না -- স্বাদ।

চন্দননগর বলতে লোকে বোঝে জগদ্ধাত্রী, কানাই লাল, ফরাসী আর স্ট্র্যান্ড। কিন্তু কথাও কখনো শুনিনি চন্দননগর খাওয়ার দাওয়ারে ফেমাস। কিছু লোকে চেষ্টা করেছে জলভরার পেটেন্ট টাকে ভিড়ের মধ্যে থেকে উঁচু করে ধরতে। কিন্তু ভায়া, চন্দননগর শুধু জলভরা তেই শেষ নয়। কড়া পাকের বন্ধনীতে নরম ভেজা ভেজা স্বাদ অবশ্যই অতুলনীয় কিন্তু সেই কড়া পাকের বেষ্টনীতে ঝাল ঝাল আলুর পুরে তেতুল-লেবুর জলের ছোয়ায় বেনারসী যা জাদু চালায় তা কি ভোলা যায়। চালায় না চালাত আমার কাছে খবর নেই। তবে ঢেকুর তুললে এখনো সেই স্বাদ এসে যায়।

এখানে বলে রাখা ভালো। আমার এই লেখার বিষয়বস্তু সেই সময়ের , যখন সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চুটিয়ে প্রেম করছি। প্রেমের পান্তুয়ায় ফুটপাথের গোলাপ জল মাইল মিশে একেবারে গুলাব জামুন। এখন যদিও CCD বা ম্যাকডোনাল্ড না হলে নাকি প্রেমিকার কাছে মান থাকে না। আমার মফস্সলীয় প্রেম খালি পকেটের দিকে বিশেষ তাকাত না। তাই আমাদের ফুটপাথই সম্বল ছিল। ভুড়িটা তখনও গর্ভে। তাই পৌষ্টিক মূল্যের থেকে খাদ্যমূল্য বিচার করাটাই তখন প্রাথমিকতা।

সেই সময় আমি একটা লিস্ট বানিয়েছিলাম। কোথায় কোথায় কি কি ভালো খাওয়ার পাওয়া যায়। যদিও কচি বান্ধবীর হাত ধরে বাঁশবনে বাঁশপাতা চেবাতেও ভালো লাগে, তবু আমার জিভ আমার প্রথম প্রেম। তাই এই চতুর্থ ইন্দ্রিয়ের আগে সেবা করে তারপর বাকি ইন্দ্রিয়র দিকে ধ্যান যেত।

সে যা হোক। সে সময় আমার পরিধি ছিল চন্দননগর স্টেশন রোড থেকে মানকুন্ডু স্টেশন রোড এর মাঝের জায়গাটা। জগধাত্রী ঠাকুর দেখার রুট ধরেই শুরু করি আমার খাদ্যভিজান।

চন্দননগর স্টেশনের তিন নম্বর প্লাটফর্ম থেকে লাইন টপকে নিচে নামলে একটা ঘুমটি ছিল অমৃতির। সে অমৃতি এক নম্বর না হলেও আমার খাওয়া সেরা তিন এ সে সব সময় থাকে। তখন একটা মুসো লোক লুঙ্গি বেঁধে কালো করাই তে নিখুত ভাবে প্যাঁচ ছাড়ত আমি সেই প্যাঁচেই কাত। কুরমুরে অমৃতি ভেঙ্গে গড়িযে পরা রস সামলাতে সামলাতে KMDA র দিকে এগিয়ে যেতে নাকে আসতো  করাইসুতির কচুরির গন্ধ। কিন্তু প্যাক করে বাড়ি আনলে তার স্বাদ এক চতুর্থ হয়ে যেত। তাই ওখানেই বসে খাও। সাথে ধুলো।

খাওয়া শেষ হলে স্টেশনটাকে পেরিয়ে ডানহাতে পরত অম্বর এর দোকান। অনেকে বলে বিরয়ানী নাকি অসাধারণ বানায়। হতে পারে। কিন্তু এগ চিকেন রোল যা বানাতো তার তুলনা হয়না। পার্কস্ট্রিট এর কাঠি রোল এই রোলের বেশ কিছু পরে রাখব। বেহালা বাজারের হাজির রোল খাওয়া গর্বিত কলকাতা বাসীর প্রতি একটাই কথা, "ভালো খাবার বানাতে একটু যত্ন লাগে।" এদের লাচ্চার সাথে ডিম ও মুরগি এমন ভাবে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত যে কে আগে  এসেছে তার বিচার করাই ভুলে যেতাম।
গড়িয়ে পরা সস মুছে নিয়ে স্টেশন রোড ধরে আরো কিছুটা এগোতে ডান হাতের ফুটপাতে একটা চপের দোকান ছিল। লোকে ধোকা ভাজা কিনতে যেত। আমার কিন্তু প্রিয় ছিল পিয়াজি। তার প্রস্তুতির ধরন ছিল কিছুটা আলাদা। সাধারণত পিয়াজির মসলা মাখা হয় শুকনো শুকনো করে। যাতে ভাজার পর পিয়াজ গুলো আলাদা আলাদা দেখা যায়।  কিন্তু এর ধরন ছিল প্রথমে ফুলুরির মত করে পিয়াজের বরা ভাজা, আর তারপর সেটা হাতের তালু দিয়ে থেবড়ে আবার ভাজা। ভয়ংকর অসাস্থকর হলেও অসাধারণ খেতে ছিল সেই পিয়াজি।

পিয়াজি হাতে ধরেই রিক্সায় আরো বেশ কিছুক্ষণ গেলেই মোদক সুইটস পরে রাস্তার বা হাতে। বনেদী চন্দননগর তখন দিধাবিভক্ত ছিল - মোদক আর সূর্য মোদক। সূর্য্য মোদকের কথা পরে বলব। তবে মোদকের স্বাদ ছিল অসাধারণ। মোদকের অনেক মিষ্টির নাম অনেকেই করবে তবে সেই সময় আমি শুধু মিহিদানা কিনতাম। বর্ধমানের মিহিদানার পরেই যদি কোনো মিহিদানা কে রাখতে হয় তাহলে আমি মোদক কেই রাখব। তখন কার দোকান দরের মেজাজ ছিল বড় চড়া। তবু ভলো জিনিসের জন্য লোকে লাইন দিত।

আর একটু এগোলেই কালিতলার ঠিক আগেই পরবে রয়াল বিরিয়ানি। সে সময় প্রথম কেউ টক্কর দিয়েছিল অভিনন্দন এর বিরিয়ানি কে। ইটা সম্পূর্ণ আমার মত। এদের চিকেন চাপ আর মটন বিরিয়ানি এক সময় আমাদের বাড়ির অথিতি অপ্পায়নের এক প্রধান উপাদান ছিল। আমিনিয়ার বিরয়ানী যখন প্রথম খেলাম তখন মনে হয়েছিল বড় হালকা , কিন্তু পরে বুঝেছিলাম সেটাই আমিনিয়ার বৈশিষ্ট। এত বছর ধরে একে একে কলকাতার আলু দেওয়া বিরয়ানী, হায়দ্রাবাদের paradise বিরয়ানী, লখনউ হাজী বিরয়ানী, মুম্বাই বিরয়ানী এবং বিদেশে বাংলাদেশী ও তুর্কিশ বিরয়ানী , শেষে সান মসলা দেওয়া বউ এর বিরয়ানী খাবার পর একটা জিনিস মনে হয়েছে যে বিরয়ানী আসলে ভাত আর মাংশ,  যে যেমন পারে বানায়। মসলার সামান্য এদিক ওদিক,  আর বিভিন্ন দোকানের বিরয়ানী বেরিয়ে আসে। তাই যার যেটা ভালো লাগে সেটাই সেরা হয়ে দাড়ায়। আমার কাছে এখনো হ্য্দেরাবাদ এর বিরয়ানী সেরা, কিন্তু দ্বিতীয় সেই রয়াল। যদিও পরে শুনেছি পয়সার লোভে স্বাদ দিয়েছে বিগড়ে। যদিও আমি তখনকার কথা বলছি যখন রয়াল বিরয়ানী একতলা ছিল।

ভুরভুরে জাফরান এর গন্ধ নাকে নিয়ে রাস্তার ওপারে তাকালেই দেখতে পাওয়া যাবে শাহজাদী রেস্তুরেন্ট। রয়াল খোলার আগে এর রমরমা সাংঘাতিক ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে শুকোতে লাগলো। আমি এখানে যেতাম মোগলাই খেতে। মোগলাই এর স্বাদ মোটামুটি সারা বঙ্গেই সমান। এর স্বাদে একটু ভিন্নতা এনে দিয়েছিল একটি অতিরিক্ত ডিম আর চিনেবাদামের গুড়ো। এর আগে আমি স্বপ্না সিনেমা হল এর কাছে এক দোকান থেকে মোগলাই খেতাম ( ক্লাস ওয়ান থেকে) . কোনো এক সন্ধ্যায় আমার দোকান পাল্টে দিল এর স্বাদ।

মোগলাই খেয়ে বেরিয়ে এবার বাগবাজারে ঢুকে কোর্ট মোড়ে পর্বে হালদার সুইটস। চকলেট রসগোল্লা, মালপওয়া আর রাধাবল্লভি এই তিনটি তে চন্দনগরে কেউ ধারে কাছে আসতে পারবে না। নবদ্বীপের চকলেট রসগোল্লা,  পুরীর মালপওয়া (জগন্নাথ এর ব্রেকফাস্ট) আর ভবানীপুর এর রাধাবল্লভী  যদিও প্রথম স্থান অধিকার করে তবু হালদার দ্বিতীয় নম্বরে অনায়াসে ঢুকে পরে।

হালদার ছাড়িয়ে জি টি রোড ধরে সুইট হার্ট আইস ক্রিম এর দোকান। সেসময় আর কোনো কায়দা মারা আইস ক্রিম এর দোকান ছিল না। তাই অগত্যা তাকেই বেস্ট মনে করে ছিলাম। কিন্তু পরে যখন আমেরিকায় কোল্ড স্টোন এর আইস ক্রিম খেলাম। তখন মনে হলো, বেচারারা যদি সত্যি জানত পাই ক্রাস্ট  আর পেকান এর কথা, আর স্ট্রবেরি যদি বঙ্গভূমির গাছে গাছে ফলত তাহলে সে ই হত সেরা। কিন্তু চার কিলোমিটার বাই চার কিলোমিটার শহরে তাদের এই উজ্যোগ ভাবা যায় না। আমি তখন নতুন প্রেম , ফুটপাথ থেকে যখনি চোখ তলার মত পয়সা হাত খরচা থেকে জমিয়ে নিতাম , তখনি দুজনে গিয়ে লম্বা গ্লাস এ স্যুট হার্ট স্পেশাল খেতাম। তখন কিছুই জানতাম না। তাই সবসময় স্পেশাল টাই বেছে নিতাম যাতে টপিং গুলো বলতে হত না। ওরাই বানিয়ে দিত। আর প্রত্যেক বারে নতুন নতুন টেস্ট করা যেত। ব্ল্যাক কারেন্ট ছিল আমার favourite flavour.

সেখান থেকে বেরিয়ে ছবিঘর ধরে ঢোকার আগেই পরবে মৃত্যুঞ্জয় সুইটস। যে সময়ের কথা বলছি তখন এই দোকানটা সদ্য খুলেছে। মৃত্যুঞ্জয় অনেক পুরনো দোকান। আদি দোকান ভদ্রেশ্বর এ। আমরা ভদ্রেশ্বর থেকে চলে আসার পর আমি চার কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে দই আনতে যেতাম সেই দোকান থেকে। বঙ্গের মিষ্টি দই বিশ্ববাসীর কাছে জনপ্রিয়। কিন্ত তারাই একমাত্র আসল মিষ্টি দই এর স্বাদ পাবে যে আসবে মৃত্যুঞ্জয় এ দই খেতে। আমি বহুবার বহুলোকের কাছে এই কথা বলে প্রথমে ঠাট্টার পত্র হয়েছি। পরবর্তীকালে তাদের সেই দই খাইয়ে আমার জিহ্বার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছি। এর যে মোলায়েম স্বাদ এবং মিষ্টতা, তা সত্যি অতুলনীয়। নতুন এই দোকান হওয়ার পর সকালে মারা মারি পরে যেত দই নেওয়ার জন্য। সকাল ৮ টায় গাড়ি আসতো, আর সাড়ে ৮টার  মধ্যে তিরিশ হাঁড়ি দই শেষ। প্রায় ১০০ কিলোর উপর।
দই দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে মৃত্যুঞ্জয় নিজের কৃতিত্ব দেখাতে লাগলো সব মিস্টিতেই। মোদক আর সূর্য্য মোদক থেকে অনেক বনেদী খদ্দের ধীরে ধীরে দোকান বদল করে ফেলল। যে মিষ্টি মৃত্যুঞ্জয় এ তৈরী হয় সেটাই হয়ে দাড়ায় সেরা। এবং শেষ মেষ আমার বিয়েতেও এরাই মিষ্টির যোগান দেয়। যদিও আমার খুঁতখুঁতে স্বাদ কে তৃপ্ত করার মত উল্ল্যেখযোগ্য ছিল রসমাধুরী। এ ছাড়া বিশেষ কিছু আমিএখানে লিখতে চাইনা।

বড় হাঁড়ির ওপর থেকে কেটে ১০০ গ্রাম এর একটা ছোট ভাঁড়ে নিয়ে, ছোটো চামচে ছোট ছোট কামর দিয়ে হাঁটতে থাকুন স্ট্র্যান্ড এর দিকে। দইটা যখন প্রায় শেষ দেখবেন ডান হাতে পরবে বলাই এর দোকান। কথাও কোনো লেখা দেখতে পাবেন না। কারণ রাস্তায় যেকোনো লোক কে ধরে জিগ্গেস করবেন বলাই এর দোকান কোথায় , সবাই দেখিয়ে দেবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দোকানের সামনে দাড়িয়ে ডানদিকে তাকান। রাস্তা পেরিয়ে চোখ যাবে, দাস বেকারীর দিকে, যেখান থেকে দুপুর তিনটের সময় আমি গরম পাউরুটি কিনে নিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি সেটার কথা বলছি না। তার পাশেই দেখবেন একটা ভাঙ্গাচোরা  ছোটো স্টল -- পরিত্যক্ত। জানিনা এখন আছে কিনা। কিন্তু ওটাই ছিল বলাই এর আদি দোকান। চরম পরিচ্ছন্নতা আর পরিমিত স্বাদের এক অনবদ্য মিশ্রন হলো বলাই এর ফিস ফ্রাই। ছোটো দোকানে  সান ফ্লাওয়ার তেলে ভাজা ফিস ফ্রাই বঙ্গে বিরল। বলাই এর কবিরাজি (অনেকেই জানেন ইংলিশ Coverage থেকে এই নামের উত্পত্তি), চিকেন কাটলেট এখনো মুখে লেগে আছে। যারা পরিমিত পয়সায় স্বাস্থ্য ও স্বাদ দুটোই এক সাথে পেতে চায় তাদের জন্য অসাধারণ জায়গা। একটা কথা বলে রাখি, স্ট্র্যান্ড এ পাওয়া বাকি সব ফিস ফ্রাই তখন হাঙ্গরের মাংশে হত, বলাই শুধু ছিল ভেটকির। তাই দাম ছিল সবার থেকে বেশি কিন্তু স্বাদ ছিল অসাধারণ।

3 comments:

  1. eta ja likhechis Chandannagar official site e dile onek lok jante parbe bhalo khabar kothay pawa jai..
    Sobhan

    ReplyDelete
  2. I agree. Let the saliva flow :P
    -aritra

    ReplyDelete